সংবাদচর্চা রিপোর্ট: রূপগঞ্জ শীতলক্ষা নদীর তীরে গড়ে ওঠা শিল্প অঞ্চল খ্যাত রাজধানীর পার্শবর্তী নারায়ণগঞ্জের অতিগুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। সম্প্রতি সময়ে রূপগঞ্জে পূর্বাচল স্যাটেলাইট শহর বাস্তবায়ন,তৃতীয় শীতলক্ষা সেতু ও ভূলতা ফ্লাইওভার নির্মাণ, রাস্তা ঘাট সহ শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় দ্রুত নগরায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
নগরায়নের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ কর্মের সন্ধানে রূপগঞ্জে আসছে তেমনি শিল্প অঞ্চল খ্যাত রূপগঞ্জে একটি প্রভাবশালী মহল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্যও বেপরোয়া হয়ে উঠছে। রূপগঞ্জকে নিজেদের দখলে রাখতে স্থানীয় ভূমিদস্যু মাদক ব্যবসায়ী জুয়ারু,চিহ্নত সন্ত্রাসীদের নেপথ্যে থেকে সব কিছুর যোগান দিচ্ছে । সম্প্রতি সময়ে বেশ কয়েকটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে পুলিশের উপস্থিতে প্রভাবশালী মহলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামী মাসুম চৌধুরী অপু রূপগঞ্জে প্রেসক্লাবে ঢুুকে প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার হুমকি দেয়। প্রতিবাদে সাংবাদিকরা কাফনের কাপড় পড়ে রূপগঞ্জ থানার সামনে মানববন্ধন করে। অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে গত আইপিএল ক্রিকেট জুয়াকে কেন্দ্র করে রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ায় সর্বশেষ ঘটে যাওয়া হত্যাকান্ডে প্রতিপক্ষের ছুড়িকাঘাতে নিহত হয় রুবেল নামে এক যুবক। রুবেল হত্যাকান্ড কোন রাজনৈতিক হত্যাকান্ড নয় যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। রুবেল হত্যা কান্ড নাটকীয় ভাবে রাজনৈতিক রূপ নিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী জানায় আইপিএলের জুয়ার টাকাকে কেন্দ্র করে নিহত রুবেলের আপন বড় ভাই মোমেনের সাথে একই এলাকার সুরুজ,নয়ন ও কাজলের সাথে কথা কাটাকাটি ধস্তাধস্তি হয়। মারামরির একপর্যায়ে বড় ভাইকে বাচাতে গিয়ে সুরুজ,নয়ন ও কাজলের ছুরিকাঘাতে মারাত্বক আহত হয় রুবেল। ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। টেলিভিশনের প্রচারিত সংবাদে ঘটনার দিন মামলার বাদী মোমেন গণমাধ্যমকে জানায় হত্যাকান্ডে সুরুজ,নয়ন ও কাজল অংশ নেয়। কিস্তু রুবেল হত্যাকান্ডের ২ দিন পরে যে মোমেন বলছে তার ভাইকে সুরুজ নয়ন কাজল হত্যা করছে সেই মোমেন ওয়ারেন্টভূক্ত পলাতক আসামী মাসুম চৌধুরী অপু ও ছাত্রলীগ নেতা হাফিজুর রহমান সজিবের নেতৃত্বে আচমকা উপজেলা পরিষদের সামনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছের বিরুদ্ধে রুবেল হত্যার অভিযোগে ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে।
বিক্ষোভ মিছিলকারীরা ওই সময়ে উপজেলা পরিষদে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক মিটিং এ উপস্থিত থাকা স্থানীয় সংসদ সদস্য,উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা,ওসি,স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সামনে ২ রাউন্ড গুলি ৩টি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। মূলত এর পর থেকেই প্রভাবশালী মহল প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানা নাটকীয়তার মধ্যে লাশ নিয়ে শুরু করে নষ্ট রাজনীতি। যার প্রেক্ষাপটে মামলার বাদী মোমেন প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করে ইউপি চেয়ারম্যান আলমাছসহ তার বেশ কয়েকজন সহযোগীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।
মামলায় উল্লেখ রয়েছে-হত্যাকান্ডের সময় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন মামলার এক নম্বর আসামী তোফায়েল আহমে¥দ আলমাছ। অনুসন্ধানে দেখা যায় আলমাছের ফোনের কললিস্ট বলছে, ঘটনার দিন ইফতার পার্টি ও নামাজ শেষে তিনি ঢাকায় তারাবির নামাযের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কললিস্ট অনুযায়ী রাত সাতটা পয়তাল্লিশ মিনিট পর্যন্ত আলমাছ ছিলেন রূপগঞ্জের কাঞ্চনে। যা ঘটনাস্থল মুড়াপাড়া থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে। আলমাছের ইফতার পার্টির অংশ নেয়ার সংবাদ বেশ কিছু গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়। কললিস্ট,টিভি ফুটেজ ও পত্রিকাতে প্রকাশিত ছবিতে বিষয়টি স্পষ্ট রয়েছে।
আলমাছ চেয়ারম্যান জানিয়েছেন-বাসায় রওনার সময়ই স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জানতে পারেন তিনি। সাথে সাথে আমি স্থানীয় থানার ওসি মনিরুজ্জামানকে ঘটনাটি অবহিত করি এবং দুই মেম্বারকে ঘটনাস্থলে পাঠাই।
ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত শেষে থানায় পুলিশের পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরী করা হয়েছে। সেখানেও আইপিএলে জুয়ার বিষয়টি এসেছে। এ সক্রান্ত সংবাদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
এজাহারে উল্লিখিত মামলার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আদালতে দায়ের করা নিহত রুবেলের আপন দুই চাচাত ভাই রমজান ও রফিকুল আদালতে হলফনামা দায়ের করেছেন। এতে তারা উল্লেখ করেছেন, আইপিএলে জুয়াকে কেন্দ্র করে ,এই হত্যাকান্ড ঘটেছে। যার সাথে সুরুজ নয়ন,কাজল জড়িত। অন্য কেউ সে সময় উপস্থিত ছিলো না।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে রুবেলের মৃত্যু হয়েছে মাথায় ও পেটে ছুড়িকাঘাতে। এজাহারে আরও উল্লেখ হয়েছে,মামলার এক নম্বর আসামী তোফায়েল আহমেদ আলমাছের হাতে থাকা পিস্তলের বাট দিয়ে নিহতের রুবেলের মাথায় আঘাত করলে মাথা ফেটে গুরুত্বও জখম হয় রুবেল। কিন্তু রুবেলের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে,রুবেলের মাথায় কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। পেটে ছুড়িকাঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে মামলার অন্যতম আসামী সুরুজ মিয়া বলেছেন আইপিএলে জুয়ায় জেতা দশ হাজার টাকা চাইতে গিয়ে মোমেন ও রুবেলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মোমেন তার বাড়িতে থাকা লোহার পাইপ দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করে তখন নয়নের হাতে থাকা চাকু দিয়ে ছরিকাঘাত করে রুবেলকে । জবানবন্দীতে সুরুজ আরও বলেন,নিহত রুবেল ও তার ভাই মামলার বাদী মোমেনের ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে রূপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান ভূইয়ার সাথে। তার সাথে আমাদের পূর্বশত্রুতা রয়েছে।
এজাহার দায়ের পর অভিযুক্ত মামলার আসামী আলমাছ চেয়ারম্যান জানান-ঘটনার দুইদিন পর জানতে পারি উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূইয়া ও আমার সাথে ইউপি নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী জব্বার মেম্বারের সরাসরি ইন্ধনে আমার বিরুদ্ধে এই মিথ্যা মামলা দায়ের করে। শাহজাহান ভূইয়া ইতিমধ্যে আমাকে বিভিন্নভাবে দেখা নেয়ার হুমকি দিচ্ছে। শাহজাহান ভূইয়া প্রকাশ্যে বলেছেন,আইন আমাদের হাতে তার যেভাবে খুশি ,তিনি সেভাবে তা প্রয়োগ করবেন।
রূপগঞ্জ উপজেলা আ.লীগের সভাপতি তোফাজ্জল মোল্লা, সহসভাপতি ইঞ্জি. শেখ সাইফুল ইসলাম থানা আ.লীগের প্রচার সম্পাদক মানজারি আলম টুটুল অভিযোগ করে বলেছেন, শাহজাহান ভূইয়া রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়া সত্ত্বেও গত ৫ জানুয়ারীর জাতীয় নির্বাচনে প্রকাশ্যে নৌকার প্রার্থীর বিরোধীতা করেন। এমনকি আলমাছ চেয়ারম্যান নৌকার প্রতীক পেলেও তার বিরুদ্ধে শাহজাহান তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জব্বার মেম্বারকে দিয়ে নৌকা প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করান।মুলত এখান থেকেই তাদের মধ্যে দ¦ন্দ্ব শুরু হয়। তাই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসতেই আবার জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হত্যাকান্ডকে বিভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে স্থানীয় আ.লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে মেতে উঠছে।
অনুসন্ধানে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ,এজাহারে উল্লেখিত সাক্ষীদের হলফনামা,১৬৪ ধারায় নেয়া জবানবন্দী,সুরতহাল রিপোর্ট,কললিস্টের বিবরণে সাজানো মামলার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
রুবেল হত্যাকান্ড নিয়ে আলমাছ চেয়ারম্যানকে জড়ানোর মূল হোতা কে তা অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে।জানা গেছে নিহত রুবেলের ভাই মোমেনের সাথে শাহজাহান ভূইয়ার ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় শাহজাহান মোমেনকে দিয়ে আ.লীগের স্থানীয় সাংসদ ও আ.লীগকে বেকায়দায় ফেলতে রুবেল হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান আলমাছকে জড়িত করে। স্থানীয়রা বলছে আগামী নির্বাচনে আ.লীগের মনোনয়ন দৌড়ে না.গঞ্জ ১ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজী তৃণমূলের ভোটে অনেকটাই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছে এগিয়ে রয়েছে। আলমাছ চেয়ারম্যান গাজীর বলয়ে থাকায় প্রতিহিসংসা করে রূপগঞ্জে গোলাম দস্তগীর গাজীর নেতৃত্বকে মেনে নিতে না পেরে হাইব্রিড নেতাদের ইন্ধনে শাহজাহান চেয়ারম্যান নিজে প্রার্থী ঘোষণা করে গাজীকে ঠেকাতে আ.লীগের ভাবমূতি নষ্ট করতে আ.লীগের মুড়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদ আলমাছের নামে হত্যা মামলা দিয়েছে।